ঠিক কোথা থেকে শুরু করব, এ নিয়ে ভাবতেই কেটে গেল অনেকটা সময়। এমন একটি বিষয়ে লিখতে বসেছি, যার সাথে প্রতিটি মানুষেরে আবেগ জড়িত। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পরও বার বার পিছু টানে ফেলে আসা দুরন্ত শৈশব। অর্থ, সম্মান, খ্যাতি- সবকিছু পাওয়ার পরও যেন সোনার হরিণ হয়ে অধরাই থেকে যায় জীবনের এই কয়েকটি বছর সময়। শৈশব জীবনের এমন একটি সময় যেখানে থাকে না কোনো সত্যিকারের লোভ, হিংসা। প্রতিটি শিশুর মনে ঢেউ খেলে যায় শুধু আনন্দধারা। শৈশবের এই দুরন্তপনা মানে না কোনো সমাজের প্রতিষ্ঠিত বাধা। শুধুই মনের খেয়ালে ছুটে চলা আমাগীর পথে। যদিও সব মানুষের শৈশব একইরকম কাটে না।
দুরন্ত শৈশব মানেই যেন, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দলবেঁধে ফুল, আম, তাল কুড়াতে বেরিয়ে পড়া। বৈশাখের তপ্ত দুপুরে অন্যের গাছের আম চুরি করে খাওয়ার পর ধরা পড়ে গাছ মালিকের গালাগালি শোনার পর ঘরে ফিরে বাবা-মার পিটুনি সহ্য করা। চুরি করে গেরোস্থর দৌড়ানি খাওয়াটাও ফল খাওয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম উপভোগের না। বৃষ্টির দিনে ভরা পুকুর, খাল, বিলে গাছের মগডাল থেকে পানিতে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া গোসল ছিল অসম্পূর্ণ। স্কুল ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মার্বেল খেলা ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। বিকালে স্কুল মাঠে ক্রিকেট, বাড়ির পাশের অনাবাদি জমিতে, বউচি, গাদন, সাত চাড়া, বোম ব্লাস্টিং, চোখবাঁধাসহ অসংখ্য গ্রামীণ খেলা কখনো ভোলার নয়। বৃষ্টির দিনে অন্যের গাছে জাম্বুরা পেড়ে অথবা তাল গাছের পাতা দিয়ে তৈরি করা বল নিয়ে কাদার মধ্যে ফুটবল খেলতে নামা আমরণ মনে থাকবে সবার। একটা ফুটবল পাওয়ার জন্য গ্রামের মাতুব্বর বা ইউপি মেম্বারের কাছে বার বার ধরনা দেওয়া ছিল এক রোমাঞ্চকর মুহূর্ত।
সন্ধ্যার পর স্কুলের পড়া কোনোমতে শেষ করে উঠানে পাটি বিছিয়ে দাদা-দাদির মুখে চাঁদের বুড়ি, রাজা-রানির গল্প শোনা ছিল দিনের সবচেয়ে সেরা সময়। মাঝেমধ্যে বধুন্ধরা মিলে কারো বাড়ির মুরগি, হাঁস চুরি করে মাঠের মধ্যে কোনো গাছের নিচে রাতভর পিকনিক করার মধ্যে ছিল আলাদা আনন্দ। গ্রামের মানুষ একটু অন্তঃর্মুখী হলেও তাদের মেয়েরাও বিকালের বান্ধবীদের সঙ্গে খেলায় অংশগ্রহণ করত। মেয়েদের অন্যতম প্রধান খেলা ছিল পুতুল নিয়ে খেলা। স্বাধীনতা দিবসে প্রত্যেক শিক্ষাপতিষ্ঠানে অনুষ্ঠান মানে ছিল যেন উৎসব। ঈদের দিন কোনোমতে নামাজ শেষ করে মার্বেল, পিস্তল এবং অন্যান্য খেলনা কিনে বাড়ি থেকে সাময়িক হারিয়ে যাওয়া ছিল প্রত্যেশ কিশোরের স্বাভাবিক ঘটনা। এভাবে কয়েকদিন চলত মার্বেল খেলার ধুম। এছাড়া আরও কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ফেলে আসা শৈশবে। যা আজ শুধু আগুন জ্বালিয়ে দেয় মনের কোনে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই শৈশবে।তবে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো এই যে, মোটামুটিভাবে ২০০৫ সালের পরে যাদের জন্ম, উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো তাদের কাছে অলীক মনে হতে পারে। হবেইবা না কেন? সময় বদলেছে না? ইন্টারনেট নির্ভর এই পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড গতিতে। এখনকার ছেলে-মেয়েরা জন্মের পর স্মার্টফোন হাতে নিয়ে বড় হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেমস খেলে সময় কাটে তাদের। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে বইয়ের ঝুলি। স্কুল শেষে ঘরে ফিরে তারা ব্যস্থ হয়ে পড়ে হাউস টিউটর বা বাড়ির কাজে। বাকি সময় কাটে তাদের টেলিভিশনে বিভিন্ন কার্টুন বা সিরিয়াল দেখে। মাঠে গিয়ে খেলার সময় কোথায় তাদের? যান্ত্রিক পৃথিবীতে এমনিতেই কোনোভাবে তাদের মাঠমুখি করা যাচ্ছে না। তারওপর শহরাঞ্চলে পর্যাপ্ত খেলার মাঠেরও রয়েছে বড় অভাব। অভিভাবকরাও যেন এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এড়িয়ে যান সন্তানদের প্রতি তাদের দায়িত্ব। এসব কারণেই এদেশের শিশুরা ভুলে যাচ্ছে তাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে ধুঁকতে থাকা গ্রামীণ সংস্কৃতি হারাতে বসেছে গৌরব। আইসিইউতে ভর্তি দুরন্ত শৈশব!




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন